মীমের বাবা কি বললেন- ‘ভাইরে, ৩০ বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছি। এত বছরেও কোনো মায়ের কোল খালি করিনি। রাস্তায় নামলেই মনে হয়, আমার মাধ্যমে যেন দুর্ঘটনা না ঘটে। কোনো মা-বাবার অভিশাপ যেন না নিতে হয়। কত সতর্ক হয়ে গাড়ি চালাই। কিন্তু ওরা আমার মানিককে কেড়ে নিল।’
চোখে-মুখে বিষাদের ছাপ নিয়ে এভাবেই কথা বলছিলেন বাস দুর্ঘটনায় নিহত রাজধানীর শহীদ বীরবিক্রম রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মীমের বাবা জাহাঙ্গীর ফকির।
গতকাল রোববার দুপুরে তার সঙ্গে যখন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে কথা হয় তখন চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিল। এ সময় আশপাশের অনেকে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। দুর্ঘটনার পর স্বজন ও নিহতের সহপাঠীদের আহাজারিতে এলাকা ভারি হয়ে ওঠে।
দুর্ঘটনার ব্যাপারে জাহাঙ্গীর ফকির আরও বলেন, এখন দেখি যার-তার হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং। লাইসেন্স থাকা না থাকারও বালাই নেই। নেশাখোররাও গাড়ি চালায়। আবার কেউ গাড়ি চালানোর আগে নেশা করে। কীভাবে তারা রাস্তায় গাড়ি সামলাবে। কীভাবে মানুষ নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছাবে।
তিনি জানান, বর্তমানে ঢাকা-রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটের একতা পরিবহনের চালক তিনি। রোববারও গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসতে সবে মহাখালীর দক্ষিণপাড়ার বাসা থেকে বের হয়েছিলেন তিনি।
তখনই তার কাছে এমন একটি দুঃসংবাদ পৌঁছল, যা তার জীবনের একটি স্বপ্নকে মুহূর্তেই ধূলিসাৎ করে দিল। পাল্লা দিয়ে যাত্রী তুলতে গিয়ে মহাখালীর বাসা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে র্যাডিসন ব্লু হোটেলের উল্টো পাশে বাসের চালক কেড়ে নিল তার মেয়ের প্রাণ।
জাহাঙ্গীর জানান, দুই মেয়ে, এক ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে ছোট্ট গোছানো সংসার তার। বড় মেয়ে রোকেয়া খানম রিয়া পড়েন মহাখালী টিঅ্যান্ডটি কলেজে। ছোট ছেলে রিয়াদুল ইসলাম আইপিএস স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। বড় মেয়েকে চিকিৎসক আর ছোট মেয়ে মীমকে ব্যাংকার বানানোর ইচ্ছে ছিল তার। তবে দুর্ঘটনার পর সেই স্বপ্ন পূরণ আর হলো না।
তিনি বলেন, কেন বাসচালকদের রাস্তায় গিয়ে পাল্লা দিয়ে যাত্রী তুলতে হবে। কেন তাদের বোধ নেই, একটু অসতর্ক হলেই কী ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে। মা-বাবার বুকের ধন কেড়ে নিতে ওদের হৃদয় কি কেঁপে ওঠে না। ওরা কি রক্ত-মাংসের মানুষ নয়। বাসের যারা চালক তারাও কোনো মা-বাবার সন্তান। তাহলে কীভাবে তারা রাস্তায় নেমে এমন নির্দয় ও নিষ্ঠুর হতে পারে।
মীমের বাবা বলেন, জীবনে তো অসৎভাবে একটি পয়সাও উপার্জন করিনি। দু’বার মহাখালী টার্মিনালের শ্রমিক নেতা নির্বাচিত হয়েছিলাম। ছেলেমেয়েকে অসৎ অর্থ দিয়ে খাওয়া-লেখাপড়ার খরচের সংস্থান করিনি। মেয়েটাকে নিয়ে হাসপাতালে কাটাছেঁড়া করতে চাই না। ময়নাতদন্ত ছাড়া যত দ্রুত সম্ভব লাশটা গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই।
জাহাঙ্গীর ফকির যখন হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে জীবনের এমন করুণগাথা শোনাচ্ছিলেন তখন জরুরি বিভাগের ভেতরে কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যাচ্ছিলেন তার স্ত্রী ও অন্য দুই সন্তান।
বোনের মৃত্যুর কথা শুনে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ূয়া ভাই রিয়াদুল স্কুল ড্রেসেই হাসপাতালে ছুটে আসে। মা আর বড় বোনকে জড়িয়ে কাঁদছিল ছোট্ট এই শিশু। রিয়াদুল জানায়, তার বোন ছিল বন্ধুর মতো। তাকে সবসময় আগলে রাখত। কান্নায় ভেঙে পড়ে মীমের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ দুই বান্ধবী অনামিকা সূত্রধর ও সুমাইয়া আক্তার তিথি।
তিথি জানায়, শুঁটকি মাছ খুব প্রিয় ছিল মীমের। এ সময় হঠাৎ কুর্মিটোলা হাসপাতাল চত্বর থেকে কয়েকশ’ শিক্ষার্থী হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে জরুরি বিভাগের ভেতরে। তারা দেখতে চায় মীমের লাশ।
শেষ পর্যন্ত জরুরি বিভাগের পাশের একটি কক্ষে রাখা নিথর মীমসহ দুই শিক্ষার্থীর লাশ তাদের দেখতে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ সময় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। মীমের মরদেহ তাদের গ্রামের বাড়ি ভাণ্ডারিয়ার জুনিয়া গ্রামে নিয়ে দাফন করা হবে বলে জানা গেছে।